করোনা আক্রান্ত মা-বাবা কে সুস্থ করে নিজেই আক্রান্ত হলেন বিচারক আলমগীর ফারুকী

 

করোনা আক্রান্ত মা-বাবার সেবা করতে গিয়ে নিজেই করোনা আক্রান্ত হলেন নোয়াখালীর অতিরিক্ত জেলা জজ আলমগীর মুহাম্মদ ফারুকী। নিজের জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেও মা-বাবার জন্য সেবা করতে একটুও পিছপা হননি তিনি ।

বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম শহরের নিজ বাসাতে আইসোলেশনে আছেন এবং চিকিৎসা নিচ্ছেন ।

তিনি এখন ভাল আছেন । করোনা আক্রান্তের নবম দিনে আজ অনেকটা সুস্থ আছেন ।

এর আগে আলমগীর মুহাম্মদ ফারুকী যে পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে গেছেন সে বিষয়ে তিনি কিছুটা লিখেছিলেন, যাতে মানুষ সাহস পায় ।

তার সেই লিখাগুলো পাঠকদের জন্য নিচে তুলে ধরা হয়েছে,

৪ জুন, আমার দুটি শ্রেষ্ঠ সম্পদ বাবা মা দুজনেই অসুস্থ। বাবা কিছুটা ভাল থাকলেও মা’র অবস্থার জন্য বেশী চিন্তিত। চট্রগ্রাম যাচ্ছি, বাড়ীর পথে। কেন জানি নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে। সবার দোয়া ও সহযোগিতা চাই.

৮ জুন, হাসপাতালে আছি গত কয়েকদিন, এটেনন্ডেন্ট হিসেবে। একই কেবিনে বাবা- মা দুজনেই অসুস্থ, শয্যাশায়ী। চিকিৎসা চলছে।

মা-র মুখে অক্সিজেন মাক্স লাগানো, অক্সিজেন স্যাচুরেশনের উঠানামা পরিমাপ করা হচ্ছে। প্রতিটি পরিমাপই যেন এক একটা স্বপ্ন ভঙ্গের আতংক।

বাবার অবস্থা কিছুটা ভাল। এমন মানসিক অবস্থায় কিছু লিখা দুঃসাধ্য। তারপরও লিখছি। এনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি এর চেয়ে কঠিন সময়ে লিখা হয়েছিল।

পরিবারে আমি একমাত্র পুত্রসন্তান। একমাত্র বোন দেশের বাইরে। অনেকেই সহানুভূতিশীল।

অনেকের অকৃত্রিম ভালবাসা আছে আমার প্রতি। অনেকেই কাছে এসে সাথে থাকতে চায়। একজন সচেতন ব্যক্তি হিসেবে আমার কাছে থাকবার অনেকের ইচ্ছাকে আমি স্বাগত জানাইনি।

বেশ কয়েকদিন আগে COVID-19 এর প্রকোপের ভাল দিকগুলো এবং আমাদের দায়িত্ব নিয়ে দুটি লিখা লিখেছিলাম। আমার পরিবারের উপর এই রোগটা বর্তমানে চেপে বসেছে কিনা জানিনা। ইতোমধ্যে বাবা- মায়ের স্যাম্পল কালেক্ট করা হয়েছে।

তারপরও আমি এই করোনার প্রকোপের পজিটিভ দিক নিয়ে আগের অবস্থানে আছি, থাকবো।

হাসপাতালে থাকতে থাকতে কেন জানি আরো সাহসী হয়ে পড়ছি। নিশ্চিত মৃত্যু আতংক থাকার পরও বাবা মায়ের প্রতি দায়িত্ব ও ভালবাসা এই ভীতিকে কমিয়ে দিয়েছে।

সন্তানের জন্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ হলো তার পিতা-মাতা। এই বিষয়টি উপেক্ষা করার কি কোন সুযোগ আছে? এই বিষয়টা কি মহান প্রভু বিবেচনায় নিবেননা??

অনেকে পিপি, গ্লাভস, স্যানিটাইজার, গগলস, মাক্স ইত্যাদি ছাড়া বাবা মায়ের কাছে বা হাসপাতালে যেতে নিষেধ করছে। নিজের স্ত্রী- সন্তানের বিষয় তারা আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে।

কিন্তু আমি জানি, নিজেকে নিরাপত্তার চাঁদরে ঢেকে ভালবাসা ও দায়িত্ব প্রদর্শন করা যায়না।

এটা হলে পৃথিবীতে অনেক বড় কাজ হতোনা। মানুষের জন্য, দেশের জন্য, মহৎ কাজের জন্য জীবন বিসর্জন দেয়া লাগতোনা, এই সভ্যতা এতদূর আসতো না।

একজন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিকে তার পরিবারের সদস্যরা ঘরে আটকিয়ে রেখে মৃত্যু নিশ্চিত করেছে মর্মে নিউজে জেনেছি। ভাবতে অবাক লাগে- মানুষ নিজেকে, নিজের জীবনকে এত কেন ভালবাসে? সীমিত আয়ুস্কালের কথা সে কিভাবে বার বার ভুলে যায়?

অক্সিজেন আমাদের কাছে শুধু একটি গ্যাসের নাম হিসেবে পরিচিত ছিল। প্রানী হিসেবে এই বিশাল পৃথিবীতে সৃষ্টিকর্তার দেয়া এই উপাদান আমরা কত সহজে বিনামূল্যে গ্রহণ করছি।

চারিদিকে অক্সিজেনের জন্য যে হাহাকার বর্তমানে দেখছি তাতে মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা ছাড়া উপায় নেই।

আমি আমার রোগীর জন্য এই গ্যাসের সংস্থান করতে হয়তোবা পেরেছি। যারা পারেননি তাদের জন্য জীবনের অপর নাম এই অক্সিজেন। তাদের অসহায়ত্বের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া করার কিছুই নেই। চট্রগ্রামের এক আঞ্চলিক পত্রিকার সাম্প্রতিক শিরোনাম ছিল- চট্রগ্রাম প্রানভরে নিঃশ্বাস নিতে চায়….

এর আগেও এমন মহামারী এসেছিল। তবে সভ্যতার চরম উৎকর্ষতার এই সময়ে আমরা অনেক ভাগ্যবান। তথ্যের অবাধ প্রবাহ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে করোনা ভাইরাস কিংবা তার চিকিৎসা ব্যবস্থা সংক্রান্ত সকল বিষয় মুহুর্তে ছড়িয়ে পড়ছে দেশ- দেশান্তরে।

বিজ্ঞানের এই উৎকর্ষতা না থাকলে পরিবেশটা হয়তোবা আরো মারাত্মক হতো, ভারী হতো। অথচ আমরা প্রাপ্তির সংবাদ না নিয়ে বার বার আতঙ্কের সংবাদগুলো নিচ্ছি। এভাবেই হয়তো আমি বা আমরা ভয়টাকে কাছে টানছি…

নির্ঘুম রাত কাটিয়ে বাসায় বিশ্রামে আসলে হাসপাতালের যেকোনো কারো ফোন কল যেন এক একটা আতংক। তারপরও সাহস দেখাই। ফোন ধরি, সিদ্ধান্ত দিই। হাসপাতালগুলোও কেমন জানি অন্যরকম হয়ে গেছে। সবাই সবাইকে সন্দেহ করে, আতঙ্ক মনে করে।

সবার মুখে মাস্ক, ব্যতিক্রমী ধরনের সব মুখোশ, কেউ কাউকে চিনতে দিতে চায়না। সবাই এক ধরনের অবিশ্বাস লালন করছে। এভাবে কি আসলে বাঁচা যায়??

সাম্প্রতিক জানলাম, গবেষনায় এসেছে- যারা A গ্রুপের রক্ত বহন করে তারা খুব বেশী Vulnerable..আশ্চর্য, আমিও তো একই অন্ধকারের ঘোর অমানিশার যাত্রী। আমিতো A positive রক্তের ধারক।

তখন হঠাৎ মনে পড়লো, মহানবী(সাঃ) এর এক কঠিন সান্ত্বনা বানী- “লা-তাহযান ইন্নাল্লাহা মা’য়ানা”, অর্থাৎ “কোনো চিন্তা করোনা, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন”।

পিতা-মাতার সাথে থাকলে, দেশের সাথে থাকলে, সুন্দর ও ভাল-র সাথে থাকলে হয়তোবা আমাদের সমস্ত অন্ধকার কেটে যাবে। আমার মাতা পিতার হয়তো ICU, HDU তে থাকা লাগতো, তারাঁ হয়তোবা চিকিৎসা বঞ্চিত হতে পারতো।

কিন্তু মহান প্রভু আমাকে এই কঠিন অবস্থা থেকে মুক্ত রেখেছেন। তারা হাসপাতালের কেবিনে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

তাই এভাবেই আমি নিশ্চিত এক নিকট ভবিষ্যৎ দেখছি, যেখানে আবার আমরা মুক্ত বাতাসে নিঃসংকোচে নিঃশ্বাস নিব, একজন অন্যকে আলিঙ্গন করবো নির্ভয়ে।

আমার বা আমাদের অন্ধকার যেন কেটে যাক, পৃথিবীর সকল পিতামাতা যেন ভাল থাকুক, সুস্থ থাকুক- এই প্রার্থনা করি…আমাকে সুস্থ রাখার এবং পিতা মাতার আরোগ্য লাভের জন্য দোয়া চাই…

১৬ জুন, দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে বাবা-মাকে গতকাল হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে এসেছি।

আলহামদুলিল্লাহ, তাঁরা ভাল আছেন। মহান আল্লাহর রহমতে ও কৃপায় আমি তাঁদেরকে ফেরত পেয়েছি।

সার্বক্ষণিক বাবা-মার পাশে থাকতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হয়েছে বারবার। সবার দোয়া ও ভালবাসা আমাকে সাহস যুগিয়েছে। সবাইকে ধন্যবাদ..