মুস্তাফিজুর রহমান, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ভারতের বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচে ৫টি উইকেট ও দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ৬টি উইকেট নিয়ে গড়লেন বিশ্ব রেকর্ড। বাংলাদেশ দলের বিজয়ের নায়ক মুস্তাফিজুরের এই সাফল্যে সাতক্ষীরার মানুষ আনন্দে ভাসছে। একই সাথে তার গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরা জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার তেতুলিয়া গ্রামে বইছে আনন্দের বন্যা।
মুস্তাফিজের বাড়িতে এখন সকাল-সন্ধ্যা ভিড় লেগেই রয়েছে। এলাকাবাসী তার পিতা-মাতা ও ভাইকে অভিনন্দন জানাতে ভিড় করছে তাদের বাড়িতে। বিশেষ করে তার যে ভাই তাকে প্রশিক্ষণের জন্য ৬০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মটরসাইকেলে করে সাতক্ষীরা গণমুখী ক্লাব মাঠে নিয়ে আসতেন, সেই মোখলেছুর রহমান পল্টুর আনন্দ যেন আজ বাঁধ ভেঙেছে। তার বাবা আলহাজ্ব আবুল কাসেমও ছেলের সাফল্যে গর্বিত। মুস্তাফিজের সাফল্যে পরিবারের সদস্যদের সাথে গর্বিত সাতক্ষীরাবাসীও। এই ক্রিকেটারের বোলিং সাফল্যের খবর পেয়ে এলাকার ক্রীড়ামোদি মানুষ সোমবার গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মধ্যে সকাল থেকে ভীড় জমায় মুস্তাফিজের গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার তারালি ইউনিয়নের তেঁতুলিয়া গ্রামে। সকলেই মুস্তাফিজুরের পরিবারের লোকজনদের শুভেচ্ছা জানায়। দলের জন্য ভাল খেলায় গর্বিত তারা বাবা-মা ও ভাইবোন। দল ও দেশের জন্য আরো ভালো খেলা উপহার দেয়ার জন্য সকলের কাছে দোয়া ও আর্শিবাদ কামনা করেন তার পারিবারের সদস্যরা।
এদিকে রবিবার রাতে খেলা শেষে তারাবি নামাজের পরপরই সাতক্ষীরা শহরে মিছিল বের করে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সাংবাদিকরা। এ সময় বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ মিছিলে যোগ দেন। সবার কন্ঠে উচ্চারিত হতে থাকে ‘সাবাস বাংলাদেশ, লাল ছালাম মুস্তাফিজ’। এ সময় মিছিল হয় পাটকেলঘাটা বিশ্বাসবাড়ি ও মুস্তাফিজের গ্রামের বাড়ি কালিগঞ্জের তেঁতুলিয়াতে।
ব্যবসায়ী বাবা আলহাজ্ব আবুল কাশেম গাজী, মা মাহমুদা খাতুনের ছোট ছেলে হিসেবে তাদের কোল আলোকিত করে ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৫ সালে সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার তারালি ইউনিয়নের তেতুলিয়া গ্রামে জন্ম নেয় মুস্তাফিজুর রহমান। চার ভাই ও দুই বোনের সংসারে খুনসুটি করতে করতে বেড়ে ওঠে দেশ কাপানো বর্তমান এই পেসার। তার বড় ভাই মাহফুজার রহমান গ্রামীনফোনের টেরিটরি অফিসার হিসেবে খুলনায় কর্মরত আছেন। মেঝ ভাই জাকির হোসেন ও সেঝ ভাই মোকলেছুর রহমান পল্টু এলাকার ঘের ব্যবসায়ী।
স্থানীয় বরেয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় ক্রিকেট খেলার প্রতি আগ্রহ জম্মায় মুস্তাফিজের। বরেয়া জিলানী হাই স্কুলে ভর্তির পর তার ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। পড়াশুনায় অতটা মন তার কখনোই ছিল না। স্কুল ফাঁকি দিয়ে সে ক্রিকেট খেলতে যেত। এরপর থেকে ক্রিকেটই তার ধ্যানজ্ঞান। বরেয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে নেট প্রাকটিস করতেন তিনি। ক্রিকেটের প্রতি তার অদম্য আগ্রহের কারণে দশম শ্রেণিতে টেষ্ট পরীক্ষা দেয়ার পরও এসএসসি পরীক্ষায় আর অংশগ্রহণ করা হয়ে উঠেনি তার। ক্রিকেট খেলায় এ পর্যায়ে আসার পিছনে তার সেঝ ভাই মোখলেসুর রহমানের অবদান অনেক বেশি। নিজের মটরসাইকেলে করে ছোট ভাইকে প্রাকটিসে নিয়ে যেতেন তিনি।
মোখলেছুর রহমান পল্টু জানান, পাঁচ বছর আগে সাতক্ষীরায় অনুর্ধ-১৪ ক্রিকেটে বাছাই পর্বে মুস্তাফিজ সবার নজর কাড়ে। তারপর তিন দিনের একটি প্রশিক্ষণ কোচ করানো হয়। এরপর ২০১০ সালে জেলা পর্যায়ে অনূর্দ্ধ-১৬ ক্রিকেট খেলায় বাছাইয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার পর সাতক্ষীরার হয়ে প্রথম মাঠে নেমেছিলো উদিয়মান এই খেলোয়াড়। এ সময় সাতক্ষীরার গণমুখী সংঘে অনুশীলন করে এবং দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেটে অংশ নেয়। গণমুখী সংঘের কোচ আলতাফই প্রথম ধরতে পেরেছিলেন মুস্তাফিজের ক্রিকেট প্রতিভা। তারই প্রচেষ্টায় উদিয়মান এই পেসার ২০১১ ও ‘১২ সালে জেলার অনূর্দ্ধ-১৮ ক্রিকেট দলে অন্তভুক্ত হয়। জেলা পর্যায়ে এসে মুস্তাফিজকে আরও পরিপক্ক করে তুলতে পরিশ্রম করেন সাতক্ষীরা জেলা কোচ মুফাছিনুল ইসলাম তপু।
জেলা পর্যায়ে খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি তাকে । ২০১৩ সালে অনূর্দ্ধ-১৯ দলের হয়ে খুলনা বিভাগীয় দলে ও পরে ডাক পান ন্যাশন্যাল লীগে খেলার জন্য। শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ফাস্ট বোলিং ক্যাম্পে ট্রায়াল দিতে এসে কোচরা আর ছাড়েননি এই প্রতিভাকে। নিয়মিতই অনূর্দ্ধ-১৯ দলে খেলেছেন। বল করতেন জাতীয় দলের নেটেও। ধারাবাহিকভাবে বোলিংয়ে সাফল্য পাওয়ায় ২০১৩ সালে অনূর্দ্ধ-১৯ দলের হয়ে খেলেন শ্রীলংকার সাথে। ওই বছরই দেশের হয়ে দুবাইতে অনূর্দ্ধ-১৯ বিশ্বকাপে খেলেন মুস্তাফিজ। ৯ উইকেট নিয়ে রেকর্ড করেন তিনি। হয়েছিলেন বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী। ২০১৫ সালে এ দলের হয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে যান কিন্তু না খেলেই দেশে চলে আসেন তিনি। ঢাকার ওয়ারী ক্লাবের হয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেট খেলেন। পরে আবাহনীর হয়ে ঢাকা প্রিমিয়ার লীগে অংশ নেন এবং দলের হয়ে প্রথম ম্যাচেই ৫ উইকেট দখল করে সকলের নজর কাড়েন। পাকিস্থানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ম্যাচে অবিস্মরণীয় প্রতিভা দেখিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্টোল বোর্ডের নজর কাড়েন।
মুস্তাফিজ এ ডিভিশনে খেলা শুরু করেন গত বছর এপ্রিলে। তার পর অভিষেক হয়েছিল ঘরোয়া এক দিনের ম্যাচে। অভিষেক ম্যাচের চোখ ধাঁধানো পারফরম্যান্স বাংলাদেশ দলে ভিন্ন এক মাত্রা যোগ করবে বলেই পূর্বাভাস দিয়েছিল। সব মিলিয়ে বলা যায় নতুন বিস্ময় হিসেবে বাংলাদেশ ক্রিকেটে আবির্ভূত হন এই ১৯ বছর বয়সী তরুণ বাহাতি পেসার।
নিজের যোগ্যতায় টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর ডাক পেয়ে যান বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে একদিনের আর্ন্তজাতিক ক্রিকেট ম্যাচ খেলার জন্য। বাঁহাতি পেসারের যে ঘাটতি অনুভব করছিলে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল তা হয়তো পুরণ করতে সক্ষম হয়েছেন সাতক্ষীরার এই কৃতি সন্তান। বৃহস্পতিবার ও রবিবার ঢাকার মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে ভারতের বিপক্ষে দুর্দান্ত বোলিং নৈপূন্য দেখিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন শিকারি বাঘের ছোট বাচ্চার নখও কতটা ধারালো। ১৯ বছর বয়সী এই বালক ২টি ম্যাচ মিলিয়ে ১১ উইকেট নিয়ে মাঠে বিধ্বস্থ করে দিয়েছেন শক্তিশালী ভারতীয় দলকে। অভিষেক এর প্রথম দিনে ৫ উইকেট ও দ্বিতীয় ম্যাচে ৬ ইউকেট নিয়ে রিতিমত বিশ্ব রেকর্ড গড়লেন। তার এই পারফরমেন্সে খুশি তার গর্বিত পিতা আলহাজ্ব আবুল কাশেম গাজী আবেগ জড়িত কণ্ঠে জানান, আমার ছেলে যে জাতীয় টিমে খেলছে এটি গর্বের বিষয়। ভারতের বিপক্ষে ছেলের খেলা দেখে সত্যিই আমি অভিভূত। দীর্ঘদিনের লালিত একটি স্বপ্ন আজ পুরণ হলো। মুস্তাফিজ আমার একার ছেলে হয়ে নয়, গোটা জাতির হয়ে ২২ গজের রণাঙ্গনে লড়বে। তিনি মুস্তাফিজের জন্য সাতক্ষীরাবাসীসহ দেশবাসীর কাছে দোয়া কামনা করেন।