আজ রানা প্লাজা ট্রাজেডির তৃতীয় বার্ষিকী

Rana plaza

বিশ্বের ইতিহাসের ভয়াবহতম শিল্প দুর্ঘটনা হিসেবে পরিচিত সাভারে রানা প্লাজা ধসের তৃতীয় বার্ষিকী আজ।ঘটনার তিন বছর পেরিয়ে গেলেও আজও  নিহত অনেক শ্রমিকে লাশের খোঁজ পায়নি স্বজনেরা। আজও মেলেনি নিহত-নিখোঁজের সঠিক সংখ্যা। রানা প্লাজা ট্রাজেডির পর নাজুক অবস্থার মুখোমুখি হয় দেশের প্রধান রপ্তানি খাত পোষাক শিল্প। এখন পর্যন্ত দেশি-বিদেশি চাপে পড়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে দেশের প্রধান রপ্তানি খাত।পোশাক কারখানার অবকাঠামো, কর্মপরিবেশ ও শ্রমমানের উন্নতির জন্য জবাবদিহিতার আওতায় এসেছেন কারখানা মালিকরা। এরই মধ্যে রপ্তানি আয় ও বিনিয়োগ বাড়ার পাশাপাশি শ্রমিকদের জীবনমানেরও উন্নতি হয়েছে কিছুটা। তবে তিন বছর আগের সেই দুর্ঘটনায় নিখোঁজ হওয়া অনেক শ্রমিকের খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি। কোনো ধরনের আর্থিক সহায়তাও পায়নি তাদের স্বজনরা। মোট কতজন এখনো নিখোঁজ—সুনির্দিষ্টভাবে এই সংখ্যাটি নিশ্চিত হওয়া না গেলেও গত বছরের ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত ১৫৯ জন শ্রমিক নিখোঁজ ছিল বলে খবর বেরিয়েছিল। বিজিএমইএ সূত্র জানায়, দুর্ঘটনায় আহত ও নিহত শ্রমিকদের মধ্যে ৩০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ২ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলার, বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান প্রাইমার্ক ৬ দশমিক ৯  মিলিয়ন ডলার, যা তারা নিজেরাই সরাসরি ক্ষতিগ্রস্তদের দিয়েছে। এ ছাড়া রানা প্লাজা ট্রাস্ট ফান্ডের মাধ্যমে অন্যান্য ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের ২০ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার দেওয়া হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট অন্য সূত্র জানায়, হতাহতদের ক্ষতিপূরণের জন্য ৪০ মিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি মিললেও শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেছে ৩০ মিলিয়ন ডলার, টাকার অঙ্কে যা দাঁড়ায় ২৩৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। রানা প্লাজা ট্রাস্ট ফান্ডের মাধ্যমে দুই হাজার ৮৩৫ জন হতাহত শ্রমিক ও স্বজনদের মধ্যে ১৮২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। এখনো ফান্ডে জমা পড়ে আছে ৫৩ কোটি টাকারও বেশি। বিজিএমইএ ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ইপিবি সূত্রে জানা গেছে, গত পাঁচ বছরে বিশ্ববাজারে পোশাক রপ্তানি আয় বেড়েছে  প্রায় ২৮ শতাংশ। ২০১১ থেকে ২০১৫ অর্থবছরে তৈরি পোশাকের রপ্তানি আয় বেড়েছে ৭৩৯ কোটি ডলার। ২০১১-১২ অর্থবছরে যেখানে পোশাক খাতের রপ্তানি আয় ছিল এক হাজার ৯২১ কোটি ডলার, সেখানে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এ খাত থেকে রপ্তানি হয়েছে দুই হাজার ৬৬০ কোটি ডলার। গত তিন বছরে পোশাকশিল্পে কেমন বিনিয়োগ হয়েছে জানতে চাইলে বিজিএমইএ সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু জানান, প্রকৃত বিনিয়োগ চিত্র তাঁদের কাছে না থাকলেও বিজিএমইএর সদস্য হালনাগাদ তথ্যের হিসাব অনুযায়ী গত তিন বছরে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। এ সময় ৫০০ নতুন পোশাক কারখানা হয়েছে। প্রতিটি কারখানায় কমপক্ষে গড়ে আট কোটি টাকা করে বিনিয়োগ করতে হয়েছে।   ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৮টার দিকে সাভার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় রানা প্লাজা নামের ভবনটি ধসে পড়ে। ভবনটিতে নিউওয়েভ বটম, প্যানথম এ্যাপারেল, প্যানথম ট্যাক, আর্থ ট্যাক এবং নিউওয়েব স্টাইল নামের পাঁচটি পোশাক কারখানা ছিল। শ্রমিকদের নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) হিসাবমতে, ওই পাঁচ কারখানায় শ্রমিক ছিল তিন হাজার ৯৪১ জন। এর মধ্যে জীবিত ও আহত শ্রমিক উদ্ধার করা হয় দুই হাজার ৪৩৮ জনকে। নিহত হয় এক হাজার ১৩৮ জন শ্রমিক। নিখোঁজ হয় ৩৬৫ জন শ্রমিক। এর মধ্যে ডিএনএ টেস্ট করে ২৬৫ জনের পরিচয় নিশ্চিত করা যায়। সেই সময় শ্রমিকদের অসহায় মৃত্যুর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় সারা বিশ্ব। আর এসব কারণে সরকার ও গার্মেন্ট মালিকরা বাধ্য হয়েই বেশ কিছু ইতিবাচক পরিবর্তনে কাজ শুরু করে। আন্তর্জাতিক চাপে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোগে গঠিত হয় অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স। তারা কারখানা ভবনের কাঠামো, অগ্নি ও বৈদ্যুতিক ত্রুটির বিষয়টি পরীক্ষা করে কী ধরনের সংশোধন কার্যক্রম চালাতে হবে তা ঠিক করে দেয়। কারখানা সংস্কারের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক সৈয়দ আহমেদ বলেন, গত দুই বছরে সবচেয়ে বড় কাজ হয়েছে ত্রিপক্ষীয় কর্মসূচির আওতায় তিন হাজার ৭৪৬টি কারখানার পরিদর্শনের মাধ্যমে কারখানাগুলোর ত্রুটি সংশোধনে করণীয় ঠিক করে দেওয়া। এর মধ্যে জাতীয় কর্মসূচির আওতায় এক হাজার ৫৪৯টি, অ্যাকর্ডের এক হাজার ৩৬৮টি  এবং অ্যালায়েন্স থেকে ৮২৯টি। এ ছাড়া ৩৯টি কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে অ্যাকর্ডের ২৬টি কারখানা, অ্যালায়েন্সের ৯টি এবং জাতীয় কর্মসূচির আওতায় চারটি। বিজিএমইএ সূত্র জানায়, গত পাঁচ বছরে শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে ২১৯ শতাংশ এবং প্রতিবছর শ্রমিকদের বেতন বাড়ছে কমপক্ষে ৫ শতাংশ হারে। এ ছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় যে কাজটি হয়েছে একটি শ্রম অধিদপ্তর করা হয়েছে। রানা প্লাজা ধসের আগে এর জনবল ছিল মাত্র ৩১৪ জন। কারখানা পরিদর্শক ছিলেন ৪২ জন এবং দোকান পরিদর্শক ছিলেন ৫২ জন। এখন সরকার এখানে জনবল দিয়েছে ৯৯৩ জন। এর মধ্যে ৫৭৫ জনই কারখানা পরিদর্শক। এর পরও বেশ কিছু কাজ এখনো বাকি বলে মনে করেন বিজিএমইএ সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে কারখানা সংস্কারে বেশ অর্থের প্রয়োজন। এ জন্য প্রতিটি কারখানা গড়ে চার কোটি টাকা থেকে ২০ কোটি টাকা পর্যন্ত লাগতে পারে। তবে এই মুহূতে সবচেয়ে জরুরি ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলোকে অর্থায়নের ব্যবস্থা করা। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে এখন শুধু কমপ্লায়েন্স  নয়, টেকসই পোশাক খাতের কথা ভেবে এখন বিশ্বমানের পরিবেশবান্ধব লিড (লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড ডিজাইন) সনদ প্রাপ্ত কারখানাও হচ্ছে। ইউনাইটেড স্টেট গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি) এই সনদ দেয়। এর মধ্যে ২৬টি কারখানা লিড সনদ পেয়েছে। এ ছাড়া ইউএসজিবিসি সনদ পাওয়ার জন্যে আরো প্রায় শতাধিক কারখানা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।